মিতুল আর ফারিন পাশাপাশি শুয়ে আছে। মিতুলের পাথুরে চোখ ফারিনকে দেখছে। ফারিনও একরাজ্যের বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে মিতুলের দিকে। তেরো বছর পর আজই দু’জনের প্রথম দেখা। মিতুলের চোখে আসমুদ্র তৃষ্ণা। ফারিনকে দেখার জন্য মিতুলের বুকে লালিত তৃষ্ণা তেরো বছর ধরে সে বয়ে বেড়াচ্ছে। আচ্ছা- ফারিনের মনেও কি তৃষ্ণা আছে? মিতুল নামের প্রতি তার বুকেও কি মায়া বেঁচে আছে? না হলে এটা কিভাবে সম্ভব হলো? মিতুল আর ফারিন একই ছাদের নিচে শুয়ে আছে। একই রুমে পাশাপাশি শুয়ে আছে তারা।
বাইরে ঝড়ো বৃষ্টির আয়োজন চলছে। ঈশানকোণে জমছে কালো মেঘের পাহাড়। উত্তরের বাতাসে লেগে আছে হিম হিম অনুভব। যেকোনো সময় ঝুম করে বৃষ্টি নামবে। মিতুল খুব বৃষ্টি পাগল ছিল। শ্রাবণের জলে ভিজে ভিজে হেঁটে যেত চারুকলা থেকে টিএসসি। মাঝেমধ্যে তার বিচ্ছু বাহিনী তার সাথে বৃষ্টি ভেজার সঙ্গী হতো। ফুলের বালতি জাকিরের চায়ের দোকানে রেখে এইসব পথশিশুরাও মিতুলের সাথে বৃষ্টিতে ভিজতো।
ফারিনের সাথে মিতুলের পরিচয় জয়নুল গ্যালারিতে। ওয়েল পেইন্টিংয়ের উপর এক্সিবিশন হচ্ছিল। সেই এক্সিবিশনে ‘নারী ও নারীত্ব’ শিরোনামে মিতুলের একটা চিত্রকর্ম সবার মনোযোগ আকর্ষণ করে। ফারিনও সেই চিত্রকর্ম দেখার পর থেকে মিতুলের সাথে কথা বলতে চাচ্ছিল। কিন্তু বিধিবাম। তার টাইমিংটা মিলছিলো না। শেষ পর্যন্ত মিতুলের এক সহপাঠীর কাছ থেকে তার মোবাইল নাম্বার ম্যানেজ করে। তারপর সেই চিত্রকর্মের সূত্র ধরে কথারা এগিয়ে যায় মনের বন্ধ দুয়ার অবধি। তারপর একদিন এক শ্রাবণের বৃষ্টিতে মিতুল বৃষ্টিতে নেমে যায়। চারুকলার পুকুরের চারদিকে সে বৃষ্টিতে একাকী হাঁটছে। ভাস্কর্য বিভাগের বারান্দা থেকে মিতুলকে একমনে দেখছে ফারিন। খুব ছেলেমানুষ মিতুল। জীবনের কোনো জটিলতা ও পঙ্কিলতা তাকে কখনো স্পর্শ করতে পারেনি। কোনো অভাববোধ বা আক্ষেপের আগুন তাকে পোড়াতে পারেনা। নির্মোহ এক সরল জীবনে অভ্যস্ত মিতুল। সেইদিনই প্রথম ফারিনও বৃষ্টিতে নেমে যায়। একদৌঁড়ে গিয়ে মিতুলের পাশাপাশি হাঁটতে শুরু করে। তারা পাশাপাশি হাঁটছে। কেউ কোনো কথা বলছে না। চারুকলা থেকে বের হয়ে ছবিরহাটের রাস্তা ধরে তারা বৃষ্টিতে হেঁটে যাচ্ছে। শিখা চিরন্তনের সামনে এক পথশিশুর কাছ থেকে একটা কদম ফুল নিয়ে ফারিন আচমকা মিতুলকে প্রপোজ করে বসে। সেইদিন দুর্দান্ত ভ্যাবাচ্যাকা খায় মিতুল। তারপর থেকে ফারিন ও মিতুল দু’জনে মিলে বৃষ্টিতে ভিজতো।
তেরো বছর পর আবার তাদের দেখা। অনাকাঙ্ক্ষিত এক জায়গায় বহুল প্রত্যাশিত দেখা হয়ে গেল। মিতুল ও ফারিন পাশাপাশি শুয়ে আছে। বাইরে ঝড়ো বৃষ্টি শুরু হয়েছে। অথচ তারা কেউ আজ টেরও পাচ্ছে না। আচ্ছা- তারা যদি বৃষ্টি হওয়ার খবর পেত, তবে কি ঝুপ করে বৃষ্টিতে নেমে যেত? পাশাপাশি হাত ধরে হেঁটে যেত এই নাগরিক শহর? অথচ তাদের রুমে এখন সুনসান নীরবতা। কারো মুখে কোনো কথা নেই। সময় বয়ে যাচ্ছে কীর্তিনাশার জলের মত। খুব সহজ ও সাবলীলভাবে। মাঝখানে দুইজোড়া চোখ আটকে আছে বর্তমানে। আটকে থাকতে চাইছে শত শত জনম।
ডাক্তার রাব্বির সাথে আইসিও রুমে ঢুকলেন এক ভদ্রলোক। স্বাস্থ্যবিধি মেনেই তিনি আইসিও রুমে এসেছেন। আগাগোড়া প্রটেকশন নিয়ে ফারিনের বেডের পাশে এসে থামলেন। নিরাপদ দূরত্ব রেখে। মিতুল বুঝতে পারে এই সেই ভদ্রলোক। যিনি তার ফারিনকে ভাগিয়ে নিয়েছেন। একজন তুখোড় পুলিশ কর্মকর্তা। ফারিনের নিজের মহল্লায়। রাজশাহী শহরে। ফারিনের বাবার ছাত্র। একাউন্টটিং পড়ুয়া ফারিন হয়ত অঙ্কগুলো ভালোই কষেছিল সেদিন। অতীতের এসব প্রশ্ন মনে আসছে মিতুলের। এসব ভাবতে ভাবতে তার শ্বাসকষ্ট বাড়ছে। ফারিনের ডানহাতে স্যালাইন পুশ করা হয়েছে। সেই হাতটা সে এগিয়ে দিচ্ছে ভদ্রলোকের দিকে। কিন্তু লোকটা সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ করেনি। হয়তো করোনার ভয়। নিজেকে হয়ত বেশি ভালোবাসেন! ডাক্তার রাব্বি ভদ্রলোককে অক্সিমিটারের স্ক্রিনের দিকে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছেন। ফারিনের রক্তে অক্সিজেনের লেবেল এখন কিছুটা স্টেবল আছে। ডাক্তারের সাথে আসা ভদ্রলোকসহ তারা দু’জন আইসিও রুম ত্যাগ করে।
ফারিনের চোখের কোণে কয়েক ফোঁটা জল চিকচিক করছে। মিতুলের চোখ এড়াতে পারেনি ফারিনের চোখের সেই জল। এখন মিতুলের খুব ইচ্ছে করছে ফারিনের হাতটা ধরতে। অথচ তেরো বছর আগে ফারিন যেদিন প্রথম স্পর্শ করেছিল মিতুলকে, সেদিনই সে ফারিনকে কিছু না বলেই বান্দরবান চলে গিয়েছিল। সাতদিন পাহাড়ে পাহাড়ে সেই স্পর্শের অনুভব ছড়িয়ে দিয়ে সাতদিন পর ঢাকায় ফিরে এসেছিল। মিতুল তার বাম গাল বাম হাত দিয়ে ঢেকে রেখেছে। ব্যাপারটা ফারিনকেও বেশ সুখ দিচ্ছে। গত সাতদিন ধরে মিতুল গোসল করেনা। স্পর্শটাকে টাটকা রাখার জন্য। স্মৃতিগুলো হুড়মুড় করে মিতুলের নিউরনে অনুরণন তুলছে। মিতুলের শ্বাসকষ্ট আরো বাড়ছে। রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা দ্রুত কমে আসছে। দম বন্ধ বন্ধ লাগছে। চোখজোড়া বুজে আসছে। কিন্তু জোর করে দু’চোখ মেলে রাখার চেষ্টা করছে মিতুল। ফারিনকে আরো কিছু সময় দেখার পিপাসা বাড়ছে। উপস্থিত নার্স দ্রুত ডাক্তার রাব্বিকে ডেকে আনে। মিতুল চলে যাচ্ছে নিয়ম অনুসরণ করে। তেরো বছর ধরে মিতুল নিজের মৃত্যুর জন্য প্রার্থনা করেছে। অথচ যমদূতের সামনে কেমন অসহায় লাগছে তাকে। সে কি আরো একটু সময় চাচ্ছে? ফারিন দেখছে মিতুলের চলে যাওয়ার তাড়া। অসহায়ের মত তার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে বালিশে। মিতুল হাসছে। বালিশের নিচ থেকে একটা চিরকুট হাতে নিলো মিতুল। প্রাণপনে চেষ্টা করছে করছে সে ফারিনকে চিরকুটটা দিতে। কিন্তু দুই বেডের মাঝখানে ছয় ফুট দূরত্ব। ডাক্তার রাব্বি বিষয়টা বুঝতে পেরে নার্সকে ইশারায় বললো ফারিনের বেড মিতুলের দিকে এগিয়ে আনতে। মিতুলের দিকে এগিয়ে আসছে ফারিন। আধখানা চোখ খুলে দেখছে মিতুল। ফারিনকে দেখছে। মিতুল তার হাতে চিরকুটটা এগিয়ে দিয়ে রেখেছে। হাতে সময় নেই তার। ফারিন চিরকুটটা হাতে নিতে নিতেই মিতুল নাই হয়ে গেল। ফারিনের হাতের ছোঁয়া লাগতেই ঝরে গেল মিতুল। ফুলদানিতে ভিজিয়ে রাখা বাসী ফুলের মত। অনুযোগহীন অভিমানে কেবলই ঝরে ঝরে যায়।
রফিকুল নাজিম, পলাশ, নরসিংদী।