রাস্তার ধারে একটা বেঞ্চে বসে গভীর ভাবনায় মগ্ন পন্ডিত বিদ্যা মশাই। উত্তরাধিকার বলে পাওয়া এবং নিজ অর্জিত যাবতীয় সম্পত্তি এখন শেষ প্রায়। ব্যাংকে গচ্ছিত কয়েকটি টাকাই এখন শেষ সম্বল। তবু মানুষের জন্য ভাবনা তাঁর। ভাবছেন শেষ সম্বলটুকু দিয়ে একটি মুদির দোকান দিবেন।
যেখান থেকে আর্থিক সংকটে থাকা মানুষ নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি কিনতে পারবেন। অবশ্য বিনা পয়সায় দিবেন না- বাকীতে দিবেন। পরে সুবিধা মতো সময়ে তারা তা শোধ করে দিবেন। এখন আর একেবারে বিনা পয়সায় পণ্য দেওয়ার মতো আর্থিক অবস্থা নেই পন্ডিত বিদ্যা মশাইয়ের।
বৃদ্ধ পন্ডিত বিদ্যা মশাই ছোট বেলা থেকেই পরোপকারের ঢেঁকি। সম্পত্তির বেশির ভাগ ব্যয় করেছেন অসতপুর গ্রামের মানুষের ভাগ্য উন্নয়নে। সারা জীবন পড়িয়েছেন গ্রামের নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। সেখানকার বেশির ভাগ আয়-রোজকারও তিনি খরচ করেছেন মানুষের জন্য। বিদ্যালয়ে পাঠদানকৃত পাঠ্যপুস্তক ছাড়াও নানাবিধ বিষয়ে তার অগাধ জ্ঞান।
সারাজীবন এক প্রকার বিনামূল্যেই তিনি শিক্ষার দ্যুতি ছড়িয়েছেন। গ্রামের মানুষের বিপদ-আপদে তিনি ছিলেন ছায়ার মতো। দিয়েছেন জ্ঞান-বুদ্ধি, সদুপদেশ ও সুপরামর্শ। এই জন্যই অসতপুরবাসী সম্মানস্বরূপ তাঁর নাম দিয়েছেন- পন্ডিত বিদ্যা মশাই। এখন অবস্থা এরকম পন্ডিত বিদ্যা মশাই নামের আড়ালে তাঁর আসল নাম ঢাকা পড়ে গেছে। চারদিকে নদীবেষ্টিত একটি ছোট্ট গ্রাম অসতপুর। দেখতে প্রায় দ্বীপের মতো। গ্রামের পূর্বদিকে একটি লম্বা সড়ক। সড়কের শেষে একটি কাঠের সেতু। এই সেতুর মাধ্যমেই গ্রামটি অন্য গ্রামের সাথে সংযুক্ত হয়েছে। এই একমাত্র রাস্তা ধরেই গ্রামবাসীকে বাইরের দুনিয়ায় যেতে হয়।
সংযোগ সেতুটির পাশেই বসানো হলো দোকানের টংঘর। দু’চালার টংঘরে তোলা হলো চাল, ডাল, তেল, লবন ও চিনিসহ যাবতীয় নিত্য প্র্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে ক্রেতার সংখ্যা। অনেকেই নগদ টাকায় দ্রব্যাদি কিনছেন। যাদের আর্থিক সমস্যা আছে তারা নিচ্ছেন বাকিতে। তবে যারা বাকিতে ক্রয় করছেন তাদের মাত্র কিছু অংশ সময়মতো দোকান বাকীর টাকা দিচ্ছেন। যারা টাকা দিতে বিলম্ব করছেন পন্ডিত বিদ্যা মশাই বাকীর নামের ফর্দ ধরে তাদের তাগাদা দেন। তবে তাতে কাজ হচ্ছে যৎসামান্য।
এভাবেই বছরখানেক গেল। দু’বছরের মাথায় পন্ডিত বিদ্যা মশাই লক্ষ্য করলেন- বিগত ছয় মাস কী এক বছর যাবত এই রাস্তা দিয়ে অনেককেই চলাচল করতে দেখেন না তিনি। এর মধ্যে ভুলে গেছেন অনেকের চেহেরা। কোথাও কি যায় না তারা? পন্ডিত বিদ্যা মশাই ভাবেন মনে মনে- কোথাও যেতে চাইলে তো এটাই একমাত্র রাস্তা। এই রাস্তা ছাড়া গ্রাম থেকে বের হওয়ার কোনো উপায় নেই। আরও কিছুদিন যাওয়ার পর দোকানের ক্রেতার সংখ্যা প্রায় শূন্যের কোঠায় এসে দাড়ালো। দোকানের মালামাল আর পুঁজিও একেবারে শেষ পর্যায়ে।
একদিন পন্ডিত বিদ্যা মশাই সিদ্ধান্ত নিলেন- এভাবে আর বসে থাকা যায় না। কিছু একটা করা দরকার। তিনি পরদিন বাড়ি থেকে বেড় হলেন- কাঁচা রাস্তা ধরে সোজা হেঁটে গিয়ে দাঁড়ালেন গ্রামের পশ্চিম প্রান্তে নদীর তীরে- গ্রামের চারপাশ দিয়ে বয়ে চলে গেছে এই নদীটাই। আসাধারণ রূপবতী নদী। প্রতিবারই নৌকাভর্তি হয়ে মানুষ পারাপার হচ্ছে আসা যাওয়ার সময়। যারা পন্ডিত বিদ্যা মশাইয়ের দোকানের ক্রেতা ছিলেন। যাদের তিনি বিগত এক-দেড় বছর যাবত দেখেন না।
তাদের অনেককেই তিনি দেখতে পেলেন খেয়া পারাপার হতে। তাঁর মুখে একটা গভীর চিন্তার ভাঁজ পড়ে গেলো। অত্যন্ত আহত হলেন তিনি। ফিসফিস করে বললেন, “আমার এক জীবনের নিরলস ভালোবাসার মূল্য এরা এভাবে দিলো- মানুষ এতটা নির্বোধ হয় কী করে?”। পন্ডিত বিদ্যা মশাই বুকের বামপাশ চেপে ধরে একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে আস্তে করে মাটিতে বসেন। আমার এক জীবনে তাদের জন্য কিছুই করতে পারলামনা অথবা আমার কোনো চেষ্টাই তাদের কোনো কাজে আসেনি তিনি আকাশের দিক তাকিয়ে এ কথা বললেন। আমার যদি একটা সন্তান থাকতো এই অবোধ মানুষগুলোকে দেখাশোনার দায়িত্বটা তাকে দিয়ে আমি নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারতাম।