মঙ্গলবার, ২৮ নভেম্বর ২০২৩, ১০:৩৩ অপরাহ্ন

পারিজাত ফুল || অপু সুলতান

অপু সুলতান / ১৪৪৬ বার
আপডেট : মঙ্গলবার, ১০ আগস্ট, ২০২১
পারিজাত ফুল || অপু সুলতান
পারিজাত ফুল || অপু সুলতান

তিতাসের তীর ঘেষা গ্রাম আসাদ নগর। অনেক দিন পর বেড়াতে যাচ্ছি। এই নদীর নির্মল বাতাস আর শীতল জল আমাকে বারবার এখানে টেনে নিয়ে আসে। অবশ্য শুধু আমি না দূর-দূরান্ত থেকেও অনেকেই এই গ্রামের মনোরম পরিবেশ আর তিতাসের বাতাসে বুক জুড়াতে আসে।

ব্রিজের শেষ প্রান্তেই আমার গন্তব্যস্থল বন্ধুর বাড়ি। তারপরেই একটা প্রকান্ড বট গাছ। আমি রিকশা থেকে নামতেই দেখলাম সেই গাছটার নিচে একটা যুবক দাড়িয়ে আছে। পকেট থেকে কী যেন বের করে নাকে নিয়ে শুঁকছে। পরক্ষণেই ভোঁ দৌড়ে একবার বট গাছের নিচে তো আবার ব্রিজের শেষ প্রান্তে। ব্যাপার কী- কিছুই বুঝে উঠতে না পেরে আমি হা-করে তাকিয়ে রইলাম। বন্ধু হাবীব বলল, ‘কী দেখছিস? ওটা একটা বড্ড পাগল।’ মনে মনে ভাবলাম এতো সুন্দর একটা ছেলে পাগল হয় কী করে।

ছেলেটার গায়ে বেগুনি রঙের টি-শার্ট। সেটা ময়লা হলেও নোংরা নয়। পরনে চেকের ট্রাউজার। মাথাভর্তি লম্বা চুল। মুখভর্তি দাড়ি। মনে হয় মাস তিনেক শেভ করেনা। গায়ের রং ফর্সা। হঠাৎ দেখে কেউ তাকে পাগল বলতে পারবেনা। বড়জোর একটু অগোছালো বা এলোমেলো বলতে পারে।

বিষয়টি কাছে গিয়ে ভালো করে বুঝার চেষ্টা করলাম। কিন্তু থামার ফুরসত নেই তার। সে পকেট থেকে একটা মালা বের করে প্রতিনিয়ত শুঁকছে আর দৌড়াচ্ছে। বটতলা থেকে ব্রিজ পর্যন্ত চক্রাকারে ঘুরেঘুরে উচ্চস্বরে একটি বাক্যই বলছে, “শোন কুহেলী, এটা বেলী নয় স্বর্গের ফুল পারিজাত”

বুঝতে পারলাম- তার হাতের মালাটা বেলীফুলের এবং কুহেলী বলে সে কাউকে সম্বোধন করছে। মাথায় কেবলই রহস্য ঝট বাঁধছে আমার। বেলীফুলের মালাকে সে পারিজাত বলছে কেন? বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলাম। হাবীব বিরক্তির সুরে বলল, ‘আর বলিস না এই পাগলা এলাকায় কোন বেলীফুল রাখেনা, ডালসহ ছিঁড়ে এনে মালা বানায়। সেই মালা পকেটে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়- শুঁকে আর প্রলাপ বকে।’

উদ্ভূত পাগল। আমি আর কথা না বাড়িয়ে বন্ধুর বাড়িতে ঢুকলাম। একটু জিরিয়েই তিতাসের শীতল জলে অবগাহন করলাম মনভরে। দুপুরের আহার শেষে লম্বা একটা ভাতঘুম দিলাম।

বিকেল বেলা দুই বন্ধু ঘুরতে বের হয়েছি। তখন অবশ্য পাগল ছেলেটাকে দেখতে পেলাম না। আমরা তিতাসের পাড় ধরে হেঁটেছি রাত অবধি। বুকভরে নিয়েছি নিখাদ অক্সিজেনসমৃদ্ধ শীতল বাতাস। মনে মনে ভাবছি- এই রকম নির্মল বাতাস যদি প্যাকেটজাত করে বাজারজাত করা যেতো, নগরের মানুষও মাঝে মধ্যে খাঁটি অক্সিজেন সমৃদ্ধ সতেজ নিঃশ্বাস নিতে পারতো।

বাড়ি ফেরার সময় পাগলটাকে দেখলাম- যথারীতি তার কাজ সে করেই যাচ্ছে। দুই বন্ধু মিলে তার কাছে গেলাম। সে দৌড়াচ্ছে আর আমরা দৌড়ের মতো হাঁটছি। আমি তার নাম জিজ্ঞেস করলাম। সে চুপ হয়ে গেলো। কিছু না বলে পকেট থেকে একটা বেলী ফুলের মালা বের করে ক্রমাগত শুঁকতে থাকলো। হাবীব বলল, ওর নাম সৌমেন ডি কস্তা। বুঝতে পারলাম সে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী।

আরও জানলাম- তার একটা কমন কবিতা আছে, যদি তার মেজাজ ভালো থাকে সেটা সে প্রায়ই উচ্চস্বরে আওড়ায়। হাবীব ফিসফিস করে বলল, ‘তুই চুপচাপ দাঁড়া, দেখি তোকে শুনানোর ব্যবস্থা করতে পারি কি-না।’ হঠাৎ পাগলটা আওড়াতে থাকলো-

“শোন কুহেলী এটা বেলী নয়-
স্বর্গের ফুল পারিজাত
বন্ধ নাসিকাও খুলে যায়
লেগে ঘ্রাণের অভিঘাত।
মোহ-মায়ায় জেগে উঠে ভিতর
বাহির-হয় কপোকাত,
শোন কুহেলী এটা বেলী নয়-
অপার্থিব ফুল পারিজাত।
কোথায় পেলে এই ফুল তুমি
স্বর্গীয় সুবাস যার,
ঈশ্বর নিজ হাতে লাগিয়েছে
মালি রেখেছে পরিচর্যার।
পূণ্যবানকে পূণ্যের তরে
দিবেন মোহনীয় উপহার,
কোথায় পেলে এই ফুল তুমি
কস্তুরী সুবাস যার।”

আমি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছিলাম। পুরো কবিতাটা বলা শেষ হতে না হতেই একদৌড়ে এখান থেকে চলে গেলো সৌমেন। স্তব্ধ হয়ে গেলাম। এটা কার লেখা? সে নিজে লেখেছে? না অন্য কারো? কবিতায় পারিজাত এবং কস্তুরি শব্দ দুটো আমাকে অন্যরকমভাবে ভাবিয়ে তুললো। পৌরাণিক কাহিনীতে স্বর্গের বর্ণানায় বারবার এসেছে এই পারিজাত ফুল। ইন্দ্রের বাগানের প্রধান বৃক্ষটিও হলো পারিজাত। মর্ত্যের রাজা শ্রীকৃষ্ণ স্বর্গের রাজা ইন্দ্রের কাছে কাছ থেকে জোর করে পৃথিবীরর বাগানে এনে লাগান এই পারিজাত ফুল।

কস্তরি বা মৃগনাভ। বিশেষ প্রজাতির পুরুষ হরিণের ১০ বছর পূর্ণ হলে- এই নাভি গ্রন্থি পরিপক্ক হয়। তখন এই গ্রন্থি থেকে তীব্র সুগন্ধ ছড়ায়। বিশ্ময়কর ব্যাপার হল এই ঘ্রাণ যখন হরিণের নাকে লাগে- তখন সে পাগলের মতো খুঁজতে থাকে ঘ্রাণের উৎস। অথচ আদৌ সে বুঝতে পারেনা তার নিজের দেহ থেকেই ছড়িয়ে পড়েছে এই মাতাল করা সুঘ্রাণ। কস্তুরী মৃগ শিকারীরা মোটা কাপড় দিয়ে নাক-মুখ বেঁধে নেয়। তারপরও তীব্র গন্ধে অনেকে জ্ঞান হারায়- এমনকি মৃত্যুও ঘটে।

বেলী দারুণ মিষ্টি ঘ্রাণের ফুল। সামনে পেলেই এর গন্ধ নেই আমি। বিমোহিত হই মনোমুগ্ধকর সুবাসে। কিন্তু এই ফুলের ঘ্রাণ কস্তুরীর মতো এতটা তীব্র নয় যে-  এর ঘ্রাণ শুঁকে কেউ সংজ্ঞা হারাতে পারে অথবা বিকারগ্রস্ত হতে পারে। কিন্তু পাগলটা বেলীকে স্বর্গের ফুল পারিজাত বলছে কেন- মনে হয় রহস্য এখানেই কাজ করছে। হতে পারে বেলী থেকে সে পারিজাত ফুলের ঘ্রাণ পেয়েছে। হয়তো বিশেষ কেউ তাকে এই ফুল দিয়েছে। বিশেষ কারো দেওয়া সাধারণ জিনিসও অতি অসাধারণ হয় উঠে কখনো কখনো।

হাবীবকে বললাম- সৌমেনের এরকম মানসিক বৈকল্য হওয়ার একটা রহস্য আছে এবং আমি সেটা উন্মোচন করতে চাই। বন্ধু আমার সৌমেনের মায়ের সাথে দেখা করিয়ে দিলো। উনি আমাকে সব খুলে বললেন। যার সার-সংক্ষেপ দাড়ায়- সৌমেন একটা মেয়েকে ভালোবাসতো। মেয়েটা ছিল রক্ষণশীল হিন্দু পরিবারের। নাম তার কুহেলী। এলাকায় তাদের প্রভাব ও প্রতিপত্তি দুটোই ছিল। কুহেলীর পরিবার ঘোর বর্ণপ্রথায় বিশ্বাসী। নিজ গোত্রের বাইরে কোনো সমন্ধ হবে সেটা তারা ভাবতেই পারেনা। আর ভিন্ন ধর্মের সৌমেন- সেটাতো কল্পনাতীত। অবশ্য সৌমেনদের পরিবার থেকে কোন বাঁধা ছিলো না। একমাত্র বাঁধ সাধে কুহেলীর বাবা ও তার পরিবার। সৌমেন-কুহেলী দুজনেই একে অন্যকে ছাড়া বাঁচবেনা। তো- কী আর করা। পালিয়ে গেলো দুজন- ঘোর বর্ষার অন্ধকার রাতে। কুহেলী ধর্মান্তরিত হয়েছিল। বিয়েও হয়েছিল দুজনের। সৌমেনের প্রিয় ফুল বেলী দিয়ে সাজানো হয়েছিল তাদের বাসর। কুহেলী নিজ হাতে বেলী ফুলের মালা বানিয়ে উপহার দিয়েছিল সৌমেনকে। ঠিক সেই রাতেই পুলিশ নিয়ে হাজির হলেন কুহেলীর বাবা। বাসর হলো না তাদের। কুহেলীদের বাড়ির ত্রিসীমানায় যাবেনা- পুলিশকে এই মুচলেকা দিয়ে এবং ঢের অর্থের বিনিময়ে ছাড়া পেল সৌমেন। ঠিক তার একমাস পর- সপরিবারে ভারত চলে যায় কুহেলীরা। এরপর আর কোন হদিস পাওয়া যায়নি কুহেলীর। সেই বিচ্ছেদের বিষাদ যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে এই অবস্থা সৌমেনের। এবার রহস্য কিছুটা ঝট খুলেছে। কিন্তু বেলীর সাথে পারিজাতের কী সম্পর্ক এবার সেটার দিকে নজর দিতে চাই। দেখলাম সৌমেনের মায়ের চোখের কোণ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে। আমি বুঝতে পারছিলাম না উনাকে কি বলে সান্ত্বনা দিবো।

আমি প্রসঙ্গটা পরিবর্তন করলাম।
-আন্টি সৌমেন কোন ঘরটায় থাকে? উনি চোখ মুছতে মুছতে তর্জনী উঁচু করে দেখিয়ে বললেন, ‘সামনের দক্ষিন পাশের রুমটায়।’
-আন্টি আমি রুমটার ভিতরে গেলাম।

-না বাবা, সৌমেন দেখলে তোমার অসুবিধা হবে। হাবীবকে বললাম- আমি ঘরে ঢুকছি তুই রাস্তায় দাঁড়িয়ে দেখ- সৌমেন আসে কিনা। ও বাড়িতে ঢুকতে ধরলে তুই আমার নাম ধরে ডাকবি। সৌমেনের মা বলল, ‘ও সাধারণত এসময় বাসায় ফেরে না।’ যাক কিছুটা আশ্বস্ত হলাম। ঘরটায় ঢুকতেই ডানপাশে একটা অগোছালো খাট। বাম পাশে একটা টেবিলে কিছু ধূলোমাখা বইপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। খাটের নিচে একটা বড় ট্রাংক। টেবিলের ড্রয়ার খুলতেই দেখলাম- কিছু পুরানো বেলী ফুলের মালা। কিছু টুকিটাকি জিনিস- এগুলো আমার জন্য এতটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। এবার দৃষ্টি দিলাম ট্রাংকের দিকে। দেখলাম তালা লাগানো। পাশেই একটা রডের টুকরো ছিল। সেটা দিয়ে কয়েকটা বাড়ি দিতেই তালাটা ভেঙ্গে গেল। দেখলাম- বেশ কয়েকটা ডায়েরি। গিফট পেপারে মোড়ানো কিছু উপহার সামগ্রী। একটা ফুলের মালা- বেলী নাকি অন্য ফুল ঠিক ঠাহর করতে পারলাম না। কিছু পুরানো চিঠি, কুহেলীকে উদ্দেশ্য করে লেখা। একটা ডায়েরি হাতে নিয়ে কয়েকটা পৃষ্ঠা উল্টাতেই স্পষ্ট হাতের লেখায় সেই কবিতা- স্বর্গের ফুল পারিজাত। আমি পড়তে ধরলাম। একটা তীব্র সুঘ্রাণ নাকে এসে ধাক্কা দিলো। কেমন যেন নেশার মতো কাজ করছে। মনে হয় বোধ শক্তি হারিয়ে ফেলছি। অসম্ভব ভালো লাগছে। আমি দিকবিদিক সব ভুলে যাচ্ছি। একটা নতুন সাম্পান। লাল-নীল-সবুজ হরেক রঙে রাঙ্গা। তিতাসের ভরা যৌবন। দু’কূল পানিতে টইটুম্বর। নিটোল স্বচ্ছ জল। বলাকার দল উড়ে যাচ্ছে। হংসমিথুন জলকেলি করছে। মাছরাঙা, পানকৌড়ি ডুবে ডুবে মাছ ধরছে। স্রোতের টানে সাম্পান ভেসে চলেছে। চারপাশে বিশাল বিশাল ফুল জলে ভেসে যাচ্ছে। একই প্রজাতির বাহারি রঙের ফুল- আকাশের মতো নীল, মেঘের মতো ধবল, দুধে আলতা মেশানো। কারা যেন ফুলগুলো ছিটিয়ে দিচ্ছে। সাম্পান ভরে যাচ্ছে ফুলে ফুলে। অপার্থিব সুগন্ধ আর মোহনীয় সৌন্দর্য ভরা দৃশ্য। একটা নারী। ময়ূর রঙের শাড়ি। হাতভর্তি রেশমি চুড়ি। একটা লাল টিপ। মায়াভরা দুটি চোখ। দীঘল কালো কেশ।

ইতোমধ্যে হুলস্থুল কান্ড ঘটে গেছে। নিজেকে হাসাপাতালের বিছানায় আবিষ্কার করি। আমি নাকি অচেতন অবস্থায় মেঝেতে পড়ে ছিলাম। তখন সৌমেনকে আসতে দেখে হাবীব আমার নাম ধরে ডাকাডাকি করে। সাড়া-শব্দ না পেয়ে তড়িঘড়ি করে ঘরে ঢুকে। আশেপাশের মানুষ জমে যায়। সৌমেন চলে আসায় সবাই, আতংকগ্রস্ত হয়ে পড়ে- কী জানি কী করে বসে। প্রথমে রাগে অগ্নিমূর্তি হলেও পরে আমার এই দুরাবস্থা দেখে সৌমেন নাকি আমাকে বলেছে- ‘ও না জেনে না শুনে তালা ভেঙে এটা ধরতে গেল কেন?’

লেখকঃ কবি ও গল্পকার
রায়পুরা, নরসিংদী।
ইমেইলঃ [email protected]

Facebook Comments Box


এ জাতীয় আরো সংবাদ

error: Content is protected !!
error: Content is protected !!