মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটসের সন্তানদের ৪৫ মিনিটের বেশি কম্পিউটার ব্যবহারের সুযোগ দেন না। এমনকি তিনি তার সন্তানকে ১৪ বছরের আগে মোবাইলই কিনে দেননি।
আফসানা আক্তার মায়া || শি’শুদের হাতে মোবাইল ফোন আভিজাত্য নাকি সামাজিক ব্যা’ধি। সন্তানকে মোবাইল ফোন কিনে দেওয়াটা যেন আজকাল আভিজাত্যের অংশ হয়ে উঠেছে।
যেটি বাবা মায়ের হাত ধরেই আসে। আজকের বেশির ভাগ মায়েরা শিশুকে শান্ত রাখতে কিংবা আনন্দ দিতে মোবাইল ফোনকে আঁকড়ে ধরেছেন। অনেকে চাকরির ও কর্মব্যস্ততার জন্য শিশুকে সময় দিতে পারেন না। কেউবা সাংসারিক ব্যস্ততায়, আবার কেউ কেউ নিজেই মোবাইল ফোনে আসক্ত।
এখন কোভিড-১৯ এর জন্য অনলাইন ক্লাস ও পড়াশোনার জন্য আমরা নিজেরাই শিশুর হাতে তুলে দিচ্ছি স্মার্টফোন নামক একধরনের প্রযুক্তিগত মাদক। বিশেষজ্ঞরা, সন্তানের হাতে স্মার্টফোন দেওয়াটাকে এক বোতল ম’দ কিংবা এক গ্রাম কো’কে’নের সাথে তুলনা করেছেন।
কারণ এটি মা’দকা’সক্তি’র মতোই বিপ’জ্জ’নক। সন্তানের আনন্দমাখা মুখেই বাবা মায়ের পরম শান্তি। তাই তাদের সব চাহিদা মেটাতে বাবা মা মরিয়া হয়ে উঠেন। এখন এটা হোক সন্তানের জন্য বিপদজনক। শিশুরা কাঁদলে আমরা মায়েরা কিভাবে কান্না থামাবো তার প্রচেষ্টা করি। এটাই মায়ের বৈশিষ্ট্য।
শিশুর কান্না থামাতে, আনন্দ দিতে মোবাইল সব থেকে সহজাত উপায়। তাই আমরা অনায়েসে তাদের হাতে ফোন তুলে দেই। এখান থেকেই শুরু হয়ে যায় শিশুর কাছে মোবাইলের প্রাধান্য। আবার খাওয়ার প্রতি অনীহা বলে মোবাইলে থাকা বিভিন্ন মিউজিক্যাল সাউন্ড ব্যবহৃত কার্টুন, শিশুদের গান, কবিতা, গ্যামস্ এগুলো দিয়ে খাওয়ানোর চেষ্টা। তাছাড়া আজকাল খেলার মাঠ নেই বিধায় অবসর সময় কাটাতে মোবাইলের ব্যবহার।
এভাবে ধীরে ধীরে আজকাল শিশুরা খেতে মোবাইল, পড়তে মোবাইল, ঘুমাতে গেলেও মোবাইলের প্রয়োজনীয়তা যেন বেড়েই চলেছে। কিন্তু আমরা অনেকেই হয়তো জানিনা দীর্ঘ সময় ধরে মোবাইল চালানোর ফলে মোবাইল থেকে নির্গত রশ্মি চোখের রেটিনাকে আঘাত করে। ফলে দৃষ্টিশক্তির ধীরে ধীরে হ্রাস ঘটে।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, শিশুরা ১ মিনিট মোবাইল ফোনে কথা বললে মস্তিষ্কে যে কম্পন সৃষ্টি হয় তা স্থির হতে ২ ঘন্টা সময় লাগে। এছাড়া অতিরিক্ত মোবাইল ফোন ব্যবহারে হার্ট অ্যাটাক, স্নায়ু দুর্বলতা, রক্তচাপ বাড়ে ও শরীরে ক্লান্তিভাব আসে যা অন্য কাজে মনোযোগ দিতে বাঁধাগ্রস্ত করে। ঘুমের সমস্যা তৈরি হয় ও মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়।
তবে মোবাইল ফোন শিশুদের উপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে। এতে করে শিশুরা কারও সাথে কথা বলতে সাচ্ছন্দ্য বোধ করে না। এমন কী কারও সাথে সহজে কথাও বলতে চায় না। যা পরবর্তীতে কথা বলায় জড়তা সৃষ্টি করে। কোন কোন শিশু অনেক দেরিতে কথা বলা শিখে। শিশুদের কানের পর্দা ও মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষ অতি কোমল ও পাতলা হওয়ায় মোবাইলের রেডিয়েশন অতি দ্রুত তাদের মস্তিষ্ককে আঘাত করে, যা নতুন কিছু শেখার আগ্রহ নষ্ট করে দেয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এটিকে একটি সম্ভাব্য কার্সিনোজেন বলে যা ক্যান্সারের সম্ভাব্য ঝুকি বহন করে। তাছাড়া জানা গেছে, শ্রবণশক্তিরও হ্রাস ঘটে। তাদের মধ্যে অলসতা কাজ করে স্থুলতা সমস্যা বাড়িয়ে দেয়। এভাবে আপনার শিশুর হাতে মোবাইল ফোন তুলে দিয়ে দেখানো মমতাটা আপনার শিশুকে ধীরে ধীরে একটি অসুস্থ্য-অচল এবং “আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ” না হয়ে আগামী দিনের অভিশাপ হয়ে দাড়াচ্ছে।
একটি গবেষণায় জানা যায়, ১১ বছর বয়সী শিশুদের প্রতি ১০০ জনের ৭০ জনই মোবাইল ফোন ব্যবহার করছে। ‘উই আর সোশ্যাল’ ও ‘হুট স্যুট’ প্রতিষ্ঠান গবেষণা করে বলেছেন, ভারত ও তার আশেপাশের দেশগুলোতেই সব থেকে বেশি স্মার্টফোন ব্যবহৃত হচ্ছে। অপরদিকে, প্রযুক্তি নির্মাতারাই তাঁদের সৃষ্ট প্রযুক্তি ও নিজের সন্তানদের মধ্যে রেখেছেন বিরাট দূরত্ব।
মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটসের সন্তানদের ৪৫ মিনিটের বেশি কম্পিউটার ব্যবহারের সুযোগ দেন না। এমনকি তিনি তার সন্তানকে ১৪ বছরের আগে মোবাইলই কিনে দেননি। আপনার সন্তানরা এটি ব্যবহার করতে পছন্দ করে কিনা এই বিষয়ে আইফোন নির্মাতা স্টিভ জবসকে জিজ্ঞেস করা হলে, তিনি উত্তরে বলেন, ‘তারা এটি ব্যবহার করেনি।’ তাঁরা তাদের সন্তানদের নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত এসব ডিভাইস থেকে দূরে রেখেছেন।
কারণ তাঁরা এর ক্ষতিকর দিকগুলো জানেন। চীন দেশে এসব ইলেকট্রিক ডিভাইস তৈরি হয়, কিন্তু সেখানে শিশুদের হাতে এসব ডিভাইজ তুলে দেওয়া হয় না। অথচ আমরা অনায়েসে আমাদের শিশুর হাতে তুলে দিচ্ছি এই অভি’শপ্ত ডিভাইজ।
আপনার সন্তানকে ভালোভাবে গড়ে তুলার দায়িত্ব আপনাকেই নিতে হবে। আমাদের মাথায় রাখতে হবে, শিশুরা অনুসরণ করে না বরং অনুকরণ করে। বাবা মায়ের মধ্যে যদি কোনো কিছুর প্রতি আসক্তি থাকে তবে শিশুরা সেটাই শিখবে। বাবা-মায়ের উচিত সন্তানদের সামনে অপ্রয়োজনীয়ভাবে মোবাইল ফোন ব্যবহার না করা। তাদের সামনে ইতিবাচক গল্পের বই, ধর্মীয় বই, শিক্ষামূলক বিভিন্ন বই পড়ুন। এতে শিশুরা নিজেরা পড়তেও উৎসাহী হবে। তাদের সময় দিন, তাদের সাথে হেসে খেলে কথা বলুন। ইতিবাচক কথা বলুন। ইতিবাচক গল্প শোনান। আবার অনেক বাবা-মা আছেন সন্তানদের দিয়ে কাজ করাতে চান না।
নিজেরা সারাক্ষণ কাজে ব্যস্ত থাকেন আর ঐ সময় শিশুরা অবসর সময় কাটায় হাতে মোবাইল নিয়ে। তাই আপনি যখন সাংসারিক কাজ করবেন আপনার সন্তানকে সাথে নিয়ে করুন। কিভাবে কী করছেন সেটা তাকে খেলার মতো করে বুঝিয়ে দিন। এতে আপনার ভালোভাবে কাজটাও হলো, সেই সাথে সন্তানও কাজের প্রতি উৎসাহিত হয়ে আপনাকে সাহায্য করবে।
মাঝেমধ্যে উপহার দিন কাজের বিনিময়ে। এতে শিশু থেকেই সে দায়িত্বশীল হয়ে উঠবে। খাওয়ার সময় মোবাইল না দিয়ে তাকে গল্প শোনান। সেটি হতে পারে শিশুতোষ বা ধর্মীয়। বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব অনুযায়ী, যখন শিশুদের পড়াতে বসাবেন তার কিছু পূর্বে সন্তানকে সাথে নিয়ে ব্যায়াম করুন। এত করে শরীরের ক্লান্তি দূর হবে। পড়ার মাঝখানে একটু বিরতি দিন এবং ঐ সময়টা সন্তানকে নিয়ে হালকা খাবার খান। এভাবেই সন্তানের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখুন স্মার্টফোন এবং গড়ে তুলুন আপনার এবং সন্তানের উত্তম ভবিষ্যৎ।
ছাত্রী, ইংরেজি বিভাগ, নরসিংদী সরকারী কলেজ।। এই ওয়েবসাইটের লেখা আলোকচিত্র, অডিও ও ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার সম্পুর্ণ বেআইনি এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ।