নাসিম আজাদ, নরসিংদী জার্নাল: সুগন্ধিযুক্ত নরসিংদীর সাগর কলা রফতানি হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের ১৬ দেশে। যুগ যুগ ধরে নরসিংদীর সাগর কলার সুনাম রয়েছে সারাদেশে।
সরকারচর গ্রামে কৃষকের সাগর কলার বাগান। ছবি: নরসিংদী জার্নাল
কলা পাকানোর তুন্দুল, যাকে আঞ্চলিক ভাষায় বলা হয় পুইন। প্রথমে কলার ছড়াগুলো তুন্দুলের ভিতর রাখা হয়, ঠিক পাশেই রাখা হয় মাটির তৈরী পাতিল বা গামলায় তুষের আগুন। ২৪ ঘন্টা পর্যন্ত তুষের আগুনের তাপমাত্রার সাহায্যে সম্পূর্ণ স্বাস্থ্যসম্মত ও পাকৃতিক পদ্ধতিতে কলাগুলো পাকানো হয়।
তুন্দুলের ভিতর কলা পাকাতে মাটির তৈরী পাতিলে তুষের আগুন
মোট কথা বাংলাদেশের মধ্যে সুস্বাদু কলার জন্য বিখ্যাত নরসিংদী জেলা। সাগর, চাম্পা বা চাপা, হোমাই, গেরাসুন্দর ও শবরী কলা সহ প্রায় ১০ প্রকার কলার চাষ করা হয় নরসিংদীর এ অঞ্চলটিতে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি কলার চাষ করা হয়, মনোহরদী, শিবপুর, নরসিংদী সদর ও পলাশ উপজেলায়।
রপ্তানির তালিকায় ২০১২ সালে যুক্ত হয় নতুন পণ্য কলা
কিন্তু উৎপাদন ও রপ্তানির ক্ষেত্রে সাগর কলাই দখল করে রেখেছে প্রথম স্থান। জেলার সবচেয়ে বড় বাজার হচ্ছে অর্জুনচর বাজার। এখানে শুধুই কলা বিক্রি করা হয়। অন্য কোনো ফসল তেমন একটা বেচাকেনা হয়না।
কৃষকরা প্রতি সপ্তাহে প্রায় ৫০ হাজারের বেশি কলার ছড়া বিক্রি করেন এ বাজারে। এসব ছড়া প্রকার বেধে ১০০ থেকে ৫০০ আবার কোনটা ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করা হয়। নরসিংদীর এ কলা ক্রয় করে দেশের বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যায় পাইকাররা।পাকনোর পর রাজধানী ঢাকায় নিতে টুকরি প্রস্তুত
এই কলার একটি অংশ রাজধানী ঢাকা হয়ে মধ্যপ্রাচ্য সহ বিশ্বের প্রায় ১৬ টি দেশে রপ্তানি করা হয়। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি উৎপাদিত ফল বা ফসলের মধ্যে, গম, ধান ও ভূট্টার পরে কলার স্থান। অর্থাৎ চতুর্থ নাম্বারে। দেশ ও আন্তর্জাতিক বাজারে দিন দিন কলার চাহিদা বাড়ায়, বেড়ে চলেছে কলার উৎপাদন।
রপ্তানির তালিকায় ২০১২ সালে যুক্ত হয় নতুন পণ্য কলা। সেই বছর বাংলাদেশ ২০ হাজার কেজি সাগর কলা পোল্যান্ডে রপ্তানি করেছে। যার রপ্তানি মুল্য ৭২৫৫ ইউ এস ডলার। রপ্তানিতে নরসিংদীর সাগর কলা নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিতে পারে বাংলাদেশের সামনে।
এব্যাপারে ৬০ বছর যাবৎ কলা ব্যাবসার সাথে জড়িত পলাশ উপজেলার বারারচর গ্রামের ফজলু মিয়ার সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি নরসিংদী জার্নালকে জানান, আমার পূর্ব পুরুষরাও কলা বিক্রির সাথে জড়িত ছিল। মনোহরদী, হতিরদিয়া, চালাকচর, চরসিন্দুর তালতলী বাজার সহ বেশকিছু বাজার থেকে আমরা কলা ক্রয় করে নিয়ে আসি।
নরসিংদীর সুগন্ধি যুক্ত সাগর কলা অমৃত স্বাদ কেন জানতে চাইলে ৭৫ বছর বয়সী ফজলু মিয়া নরসিংদী জার্নালকে জানান, তুষের আগুনের তাপ দিয়ে প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে কলা পাকাই বলে এতো সুস্বাদু। কলা বিক্রি করে যা আয় হয় সেই টাকা দিয়ে বেশকিছু জমি খরিদ করেছি, এমনকি তিন ছেলের জন্য তিনটি বাড়ি করে দিয়েছি।
একই উপজেলার জিনারদী গ্রামের কলা ব্যাবসায়ী সবুজ মিয়া বলেন, ১৮ বছর যাবৎ কলা ব্যাবসার সাথে জড়িত, আমি বেশির ভাগই কলাগুলো ক্রয় করি কৃষকের বাগান থেকে। শেখেরচর, কুড়েরপার, আসমান্দীরচর, বারারচর, জিনারদী সহ বেশকিছু এলাকার বাগান থেকে পাইকারী ধরে কলা ক্রয় করে নিয়ে আসি। দামেও একটু কম পরে আর লাভও হয় বেশি।
গাড়ী আসার আগেই জিনারদী রেলওয়ে স্টেশন ভর্তি কলার টুকরি
কলাগুলো রেলপথে নিয়ে ঢাকায় বিক্রি করি। সংসার চালিয়ে সমস্ত খরচ গিয়ে বছর শেষে প্রায় ২ লক্ষ টাকা আয় থাকে।
নরসিংদী সদর উপজেলার পাঁচদোনা চরপাড়া গ্রামের কলা ব্যাবসায়ী সারোয়ার হোসেন জানান, কৃষকের এক একটি সাগর কলার বাগানে থাকা ৪ থেকে ৮ শ ছড়া আবার কোন কোন সময় তার চেয়েও বেশি ক্রয় করি। আমাদের প্রত্যেক ব্যাবসায়ীদের সাথে ১২ থেকে ১৫ জন পর্যন্ত স্থানীয় লোকজন কাজ করে। রয়েছে নিজস্ব তুন্দুল,যেখানে আমরা কলা পাকাতে পারি। খরচও কম লাভও বেশি।
পলাশ উপজেলার খাসহাওলা গ্রামের বিল্লাল হোসেন জানান, ২০ বছর যাবৎ সাগর কলার আবাদ করি, আমার পূর্ব পুরুষরাও কলার আবাদ করতো। কলার আবাদী জমিতে আমরা সবচেয়ে বেশি জৈবসার ব্যাবহার করে থাকি। আমাদের এখানকার মাটি এটেল এবং দোআঁশ, যার কারণে কলার ফলন খুব ভালো হয়। ফলন আসার সময়টা ঘনিয়ে আসলে, জমিতে জৈবসার এবং পরিমাণ মতো সরিষা ভাঙানো খৈল ছিটিয়ে দেই। কলার কাধি বের হওয়ার পর পোকা মাকর রক্ষা পেতে জীবাণু নাশক ঔষধ স্প্রে করি। আমরা কলাগুলো বেশির ভাগ বিক্রি করি তালতলী, চর্ণগরদী ও কালির হাটে।
একই উপজেলার জিনারদী গ্রামের কলা চাষী সবুজ মিয়া জানান, প্রতি বিঘায় ৪ শ কলার চারা রোপণ করতে পারি। বিঘা প্রতি খরচ হয়, ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা, বিক্রি করতে পারি ৮০ হাজার থেকে ১ লক্ষ টাকা পর্যন্ত। কলার কাধি বের হওয়ার সাথে সাথে দাগমুক্ত রাখতে বাসুডিন বা ডিডি পাউডার পানির সাথে মিশিয়ে ছিটিয়ে দেই। এতে করে কালার ছড়ায় চমক আশে এবং বিক্রিও করা যায় বেশি দামে।
৪০ বছর আগেও কলার গাড়ী নামে একটি রেলগাড়ী ছিল এখন আর নেই
এ ব্যাপারে জিনারদী রেলওয়ে স্টেশনের লেবার ইন্চার্জ মনির হোসেনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি নরসিংদী জার্নালকে জানান, জিনারদী ও মনোহরদী সহ নরসিংদী জেলার বিভিন্ন স্থানে কলা ব্যাবসায়ীদের প্রায় ৫ শরও অধিক তুন্দুল রয়েছে। এর সাথে জড়িত প্রায় ১০ হাজার দিনমজুর। যারা প্রতিদিন কাজ করে সংসার চালায়।
সকালবেলা সিলেট মেইল আর সন্ধ্যায় কর্ণফুলী এক্সপ্রেসের দুটি লাগেজ বরাদ্দ রয়েছে
৪০ বছর আগেও কলার গাড়ী নামে একটি রেলগাড়ী ছিল, যে গাড়ি দিয়ে নরসিংদীর কলা ব্যাবসায়ীরা রাজধানী ঢাকায় কলা নিয়ে যেতো। এখন আর নেই। সকালবেলা সিলেট মেইল আর সন্ধ্যায় কর্ণফুলী এক্সপ্রেসের দুটি লাগেজ বরাদ্দ রয়েছে কলার জন্য, যা পর্যাপ্ত নয়। তবে সন্ধ্যায় সবচেয়ে বেশি কলা কর্ণফুলিতে নিয়ে যায় পাইকাররা। দুপুরের পর থেকেই জিনারদী রেলওয়ে স্টেশনে বিভিন্ন এলাকা থেকে লেবারের সাহায্যে ব্যাবসায়ীরা কলা নিয়ে আসতে শুরু করে। আর ৪০ হালি কলায় সাজানো থাকে প্রতিটি টুকরি। বিকেল ৫ টার আগেই কলার টুকরিতে কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায় রেলওয়ে ষ্টেশন।
কলাগুলো রেলগাড়ীতে উঠানো হচ্ছে
নরসিংদী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী উপজেলা ওয়ারী কলার আবাদ, মনোহরদী ৫৬৫ হেক্টর, শিবপুর ৩৩২ হেক্টর, নরসিংদী সদর উপজেলায় ২২০ ও পলাশ উপজেলায় ১৬৩ হেক্টর সহ মোট ১ হাজার ৩৭০ হেক্টর জমিতে সাগর কলার চাষাবাদ করা হয়। প্রতি ১ বিঘা জমিতে ৪০০ কলার চারা রোপণ করা হয়। এতে খরচ হয় ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকার মতো। আর ১ বিঘা জমি থেকে কলা বিক্রি করা যায়, ৮০ থেকে ১ লক্ষ টাকা। প্রতিটি সাগর কলার ছড়া প্রকার ভেদে ৫০০ থেকে ৭০০ আবার ৮০০ টাকাও বিক্রি করা যায়। কলা লাগানো জমিতে সাথী ফসল হিসেবে ধনিয়া,লাল শাক,ডাটা শাক, পেয়াজ, বাধা কপি ও ফুল কপির চাষ করে অতিরিক্ত আয় করা যায়।
এব্যাপারে নরসিংদী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) ড.মোহাম্মদ মাহবুবুর রশিদের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি নরসিংদী জার্নালকে জানান, সুগন্ধি যুক্ত সুস্বাদু এই সাগর কলা নরসিংদীর ৪ টি উপজেলায় আবাদ করা হয়। মনোহরদী, শিবপুর,নরসিংদী সদর ও পলাশ উপজেলায়।
কলায় যেন কোন প্রকার পোকা মাকর না হয়, সেই জন্য কলা চাষ পদ্ধতির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আমরা প্রদর্শনীর ব্যাবস্থা ও প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকি। কলা চাষের উপর কৃষকদের নিয়ে উঠান বৈঠক করে থাকি। আমরা গুড এগ্রিকালচার প্রেক্টিসের যে সাইডে এগুলো আছে তা কৃষকদের মাঝে প্রদর্শন করি। যার কারণে তারা বিষমুক্ত ফ্রেস কলা উৎপাদন করে। আর এখানকার কলাগুলো প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে পাকানো হয় বলে এতো সুস্বাদু।
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার সুম্পুর্ণ বেআইনি এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। নরসিংদী জার্নাল বাংলাদেশ খবর মিডিয়ার একটি প্রতিষ্ঠান।